ত্যাগের এক অনুপম দৃষ্টান্ত ঈদুল আজহা

Spread the love
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

ভুমিকা : মানব ইতিহাস যত পুরাতন কুরবানীর ইতিহাস ও তত পুরাতন। আদম (আ:) থেকে শুরু করে হযরত মুহাম্মদ (স:) পর্যন্ত যত নবী রাসূল অতিবাহিত হয়েছেন সকলের শরীয়তেই কোরবানীর বিধান ছিল। এ প্রসংগে মহান রাব্বুল আলামীন বলেন ولكل امة جعلنا منسكا ليذكروا اسم الله على ما رزقهم من بهيمة الانعام- الحج ৩৪

অর্থ্যাৎ : আমি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কুরবানীর এক রীতি পদ্ধতি নির্ধারণ করে দিয়েছি; যেন তারা ঐ সব পশুর উপর আল্লাহর নাম নিতে পারে যে সব আল্লাহ তাদেরকে দান করেছেন। সূরা হজ্জ্ব-৩৪।

মানব ইতিহাসের প্রথম কুরবানী : পৃথিবীর প্রথম মানব ও প্রথম নবী হলেন হযরত আদম (আ:)। তাঁর দু’সন্তান ছিল একজনের নাম হাবিল, অপরজন হল কাবিল।

এ দু’জনেই সর্বপ্রথম আল্লাহর উদ্দেশ্যে কুরবানী পেশ করল। তবে আল্লাহ হাবিলের কুরবানী কবুল করলেন। কিন্তু কাবিলের কুরবানী কবুল করলেন না। হাবিল মনের ঐকান্তিকতা সহকারে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যে অতি সুন্দর একটি দুম্বা কোরবানী করল।

আর কাবিল কুরবানী করল অমনোযোগিতার সাথে খাবার অনুপযোগী কিছু খাদ্য শস্য। ফলে তার কুরবানী কবুল হল না। এতে কাবিল রাগান্বিত হয়ে নিজ ভাই হাবিলকে হত্যা করল। এজন্যে কাবিলকে মানব ইতিহাসের প্রথম খুনী বলা হয়। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনের সূরা মায়েদার ২৭ নং আয়াতে বলেন-

واتل عليهم نباابنى ادم بالحق اذ قربا قربانا فتقبل من احدهما ولم يتقبل من الاخر-
অর্থ্যাৎ : আর তাদেরকে আদমের দু’পুত্রের কাহিনী যথাযথভাবে শুনিয়ে দাও। যখন তারা দু’জনে কুরবানী করল, একজনের কুরবানী কবুল হল, অপরজনের হল না (মায়েদা-২৭)।

* কাবিল কর্তৃক হাবিলকে হত্যা ও লাশ নিয়ে বিপাকে কাবিল :
আকাশ থেকে একখন্ড আগুন এসে হাবিলের দুম্বা জ্বালিয়ে দিল যা ছিল আল্লাহ কর্তৃক কুরবানী কবুলের আলামত। আর কাবিলের খাদ্য শস্য যমীনে পড়েই রইল। এতে কাবিল ক্ষোভে দু:খে বলল- “আমি অবশ্যই তোমাকে হত্যা করব”। হাবিল বলল, “আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের নজরানাই কবুল করে থাকেন”।

Aqsa IT

আল্লাহর ভাষায় انما يتقبل الله من المتقين- مائدة অর্থ্যাৎ আল্লাহ কেবল মুত্তাকীদের নজরানাই কবুল করে থাকেন। অবশেষে কাবিল হাবিলকে হত্যা করেই ফেলল, কিন্তু ভাই হাবিলের লাশ নিয়ে পড়ে গেল বিপদে। কী করবে এ লাশ ? কাঁধে নিয়ে নিয়ে ফিরল অনেকদিন পর্যন্ত। অবশেষে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আসমান থেকে একটি কাক পাঠালেন, যে কাবিলকে দেখিয়ে মাটি খুঁড়তে লাগল, যাতে ভাইয়ের লাশ সে কী ভাবে দাফন করবে তা জানতে পারে। পরিশেষে কাবিল তার কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হল।

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন-
فَبَعَثَ اللَّهُ غُرَاباً يَبْحَثُ فِي الأَرْضِ لِيُرِيَهُ كَيْفَ يُوَارِي سَوْأَةَ أَخِيهِ قَالَ يَا وَيْلَتَا أَعَجَزْتُ أَنْ أَكُونَ مِثْلَ هَذَا الْغُرَابِ فَأُوَارِيَ سَوْأَةَ أَخِي فَأَصْبَحَ مِنْ النَّادِمِينَ- مائدة

অর্থ্যাৎ আল্লাহ রাব্বুল আলামীন একটি কাক পাঠালেন। সে মাটি খুঁড়তে লাগল, যাতে তাকে দেখিয়ে দেয় তার ভাইয়ের লাশ কীভাবে লুকিয়ে ফেলবে। এ দৃশ্য দেখে কাবিল বলল হায় আফসোস! আমি এ কাকটির মতও হতে পারলাম না, যাতে নিজের ভাইয়ের লাশটি লুকাতে পারি ? এরপর নিজের কৃতকর্মের জন্য সে খুবই অনুতপ্ত হল। মায়িদাহ-৩১

* নুহ (আ:) এর যুগের কুরবানী : হযরত নুহ (আ:) কুরবানীর জন্তু জবাই করার জন্যে একটি কোরবানী গাহ নির্মাণ করেছিলেন। সেখানে তিনি জবাইকৃত সকল জন্তু জ্বালিয়ে দিতেন।
* ইবরাহীম (আ:) এর যুগের কুরবানী : ইবরাহীম (আ:) এর যুগে ও পরবর্তীতে কুরবানীর পশু যবেহ করে কাবার সামনে অথবা উপসনালয়ের সামনে রেখে দিত।

* জাহেলী আরবদের কোরবাণী: আরব দেশে ‘আতিয়া’ ও ‘ফারা’ নামে দু’শ্রেণীর বলি উৎসর্গ করত। এগুলো যে দেবতার নামে তারা যবেহ করত সে দেবতার গায়ে এ পশুর রক্ত লেপন করে দিত। অথবা তারা কোরবানী করার পর তার গোশত بيت الله এর সামনে এনে রেখে দিত, তার রক্ত বাইতুল্লাহর দেয়ালে মেখে দিত। আল্লাহ এ প্রথা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে দিয়ে বললেন-
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ- حج

অর্থ্যাৎ ওসব পশুর রক্ত ও গোশত আল্লাহর কাছে কিছুতেই পৌছেনা। পৌছে শুধুমাত্র তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীতি। হজ্ব-৩৭নং আয়াত।

* রাসূল (স:) এর যুগে কোরবাণী : রাসূল (স:) ৬২২ খ্রিষ্টাব্দে যখন মদীনায় গমন করেন তখন কোরবানীর এ বিধান কে ঈদ হিসেবে উদযাপনের ঘোষণা প্রদান করলেন। এ প্রসংগে হাদীস শরীফে এসেছে
عن انس رض قال: قدم النبى صلى الله عليه وسلم المدينة ولهم يومان يلعبون فيهما- فقال ماهذان اليومان ؟ قالوا كنا نلعب فيهما فى الجاهلية- فقال رسول الله صلهم ان الله قد ابدا لكم بهما خيرا منهما يوم الاضحى ويوم الفطر- ابو داؤد.

অর্থ্যাৎ : হযরত আনাস (রা:) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স:) যখন মদীনায় আগমণ করলেন তখন মদীনার লোকদের কে দেখতে পেলেন যে তারা দুটি দিন খেল তামাশায় লিপ্ত হচ্ছে। তখন রাসূল (স:) তাদেরকে বললেন, তোমরা এ দু দিনে কী কর ? তখন তারা বলল জাহেলী যুগে আমরা এ দু’দিন খেল তামাশা করে কাটাতাম। তখন রাসূল (স:) বললেন- এ দু’দিনের পরিবর্তে আল্লাহ তায়ালা তোমাদেরকে উত্তম দুটি দিন দিয়েছেন; আর তা হল ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আযহা। (আবু দাউদ)

আল্লাহর ও নির্দেশ এসে গেল سورة الكوثر এর মধ্যে আল্লাহ রাব্বাুল আলামীন রাসূল (স:) কে নির্দেশ দিয়ে বলেন- فصل لربك وانحر-
অর্থ্যাৎ : হে রাসূল আপনি আপনার প্রভুর উদ্দেশ্যে নামায পড়–ন এবং কোরবানী করুন। (সূরা কাউসার)।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর (রা:) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স:) মদীনায় দশ বছর অবস্থান করেছেন। প্রতি বছরই তিনি কোরবানী করেছেন। সর্বশেষ দশম হিজরীতে রাসূল (স:) ১০০ উট কুরবানী করেন।

তার মধ্যে ৬৩টি উট নিজ হাতে কুরবানী দেন, আর ৩৭ টি উট হযরত আলী (রা:) যবেহ করেন। প্রত্যেকটি উট থেকে এক টুকরো করে গোশত নিয়ে একটি হাড়িতে রান্না করা হয়। রাসূল (স:) সে গোশত থেকে আহার করেন। হযরত আলী (রা:) ও সেখান থেকে কিছু আহার করেন। হুজুর কিছু সুরুয়া ও পান করেন (মাখতুম ৪৭৭) রাসূল (স:) বলেন, ما عمل ابن ادم من عمل يوم النحر احب الى الله من اهراق الدم- (ترمذى).

অর্থ্যাৎ : কুরবানীর দিন পশুর রক্ত প্রবাহিত করার চেয়ে আল্লাহর নিকট আর কোন কিছুই অধিক প্রিয় নয়। (তিরমিযি)

রাসূল (স:) আরো বলেন, من كان له سعة ولم يضح فلا يقر بن مصلانا- (ابن ماجه).

অর্থ্যাৎ : সামর্থ থাকা সত্বেও যে কুরবানী করে না সে যেন আমাদের ঈদগাহের নিকটে ও না আসে। (ইবনে মাযাহ)

* কেন এ কুরবানীর বিধান : সাহাবায়ে কেরাম (রা:) জিজ্ঞেস করলেন- يا رسول الله ماهذه الاضاحى ؟ অর্থ্যাৎ : হে আল্লাহর  রাসূল এ কুরবানী টা কী ?

হুজুর বললেন سنة ابيكم ابراهيم عليه السلام অর্থ্যাৎ : এটি হল তোমাদের পিতা ইবরাহীমের সুন্নাত তথা আদর্শ।

তাঁরা আবার বললেন وما لنا يا رسول الله؟ অর্থ্যাৎ : এতে আমাদের জন্যে কী ফায়দা রয়েছে হে আল্লাহর রাসূল?

হুজুর বললেন بكل شعرة حسنة অর্থ্যাৎ : এর প্রতিটি পশমের পরিবর্তে একটি করে নেকী রয়েছে।

সাহাবীগণ আবার জানতে চাইলেন- فالصوف يا رسول الله ؟ ভেড়া, দুম্বার পশমের ব্যাপারে কী কথা ?

হুজুর বললেন بكل شعرة من الصوف حسنة- (ابن ماجه)   অর্থ্যাৎ : এর প্রতিটি পশমের বিনিময়ে ও এক এক নেকী রয়েছে । (ইবনে মাযাহ)।

* ইবরাহীম (আ:) এর স্মৃতি ধরে রাখার জন্যেই এ কুরবানী :
কী ছিল সে স্মৃতি ? এক বর্ণনায় পাওয়া যায় হযরত ইবরাহীম (আ:) এর বয়স ছিল ১৬৫ বছর যখন তাঁর বয়স ৮৫ তে উপনিত হল তখন তিনি আল্লাহর নিকট দোয়া করলেন। رب هب لى من الصالحين অর্থ্যাৎ : হে আমার রব আপনি আমাকে একটি নেক সন্তান দান করুন।

আল্লাহ তাঁর দোয়া কবুল করলেন, বললেন- فبشرناه بغلام حليم অর্থ্যাৎ : অত:পর আমি তাকে একজন ধৈর্যশীল সন্তানের সুসংবাদ দিলাম। হযরত ইবরাহীম (আ:) এর বয়স যখন ৮৬/৮৭ তে উপনীত হল তখন বিবি হাজেরার গর্ভে জন্ম নিলেন জগদ্বিখ্যাত সন্তান হযরত ইসমাইল (আ:)। এখানে গোলাম দ্বারা ইসমাইল কে বুঝানো হয়েছে ইসহাক কে নয়। (জালালাইন) বৃদ্ধ বয়সে সন্তান পেয়ে হযরত ইবরাহীম (আ:) আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে বললেন-
الْحَمْدُ لِلَّهِ الَّذِي وَهَبَ لِي عَلَى الْكِبَرِ إِسْمَاعِيلَ وَإِسْحَقَ إِنَّ رَبِّي لَسَمِيعُ الدُّعَاءِ-

অর্থ্যাৎ : সকল প্রশংসা আল্লাহ তায়ালার জন্য যিনি আমাকে আমার এ বৃদ্ধ বয়সে ইসমাইল ও ইসহাককে দান করেছেন। অবশ্যই আমার মালিক দোয়া শুনেন। (সূরা ইবরাহীম-৩৯) আল্লাহ তায়ালা দু’জন সন্তান ইবরাহীম (আ:) কে দান করলেন। প্রথমজন হলেন ইসমাইল (আ:)। তাঁর জন্মের আরো ১৩/১৪ বছর পর জন্ম গ্রহণ করলেন হযরত ইসহাক (আ:), যিনি ও ছিলেন আল্লাহর নেক বান্দাহ ও নবী।

তখন হযরত ইবরাহীম (আ:) এর বয়স হয়েছিল ১০০ এবং স্ত্রী সারার বয়স হয়েছিল ৯০ বছর। তাফসীরে কুরতুবীর বর্ণনার বরাত দিয়ে معارف القران এ উল্লেখ করা হয়েছে। তখন হযরত সারার বয়স ৯৯ বছর, ইবরাহীম (আ:) এর বয়স হয়েছিল ১০০ বছর। (মাআরেফুল কুরআন-১২৯৪)

অতপর হযরত ইসমাইল (আ:) এর বয়স যখন ৭ অথবা কেউ বলেছেন ১৩/১৪/১৭ বছর হল। যখন সে পিতার সাথে চলাফেরার যোগ্য হয়েছিল, লালন পালনের কষ্ট সহ্য করার পর যখন সে পিতার সাহায্যকারী হওয়ার যোগ্যতা লাভ করেছিল তখন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীম (আ:) কে প্রিয় বস্তু কোরবানী করার জন্যে স্বপ্নের মাধ্যমে নির্দেশ দিলেন।

হযরত ইবরাহীম (আ:) স্বপ্নে দেখছেন যে, এক ব্যক্তি তাঁকে বলছে যে, ইবরাহীম আল্লাহ তোমাকে তোমার পুত্র কুরবানীর নির্দেশ দিয়েছেন এভাবে পরপর একই স্বপ্ন তিন রাত্রিতে দেখলেন। স্বপ্নের এ তিন রাত্রিকে একসাথে। ايام التروية বলা হয়, (جلالين)

এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَلَمَّا بَلَغَ مَعَهُ السَّعْيَ قَالَ يَا بُنَيَّ إِنِّي أَرَى فِي الْمَنَامِ أَنِّي أَذْبَحُكَ فَانظُرْ مَاذَا تَرَى
অর্থ্যাৎ অতপর যখন সে তার সাথে চলা ফেরা করার বয়সে উপনীত হল, তখন তিনি বললেন আমি স্বপ্নে দেখছি যে আমি তোমাকে যবেহ করছি তুমি কী মনে কর ? বা তোমার কী অভিমত ? (সাফ্ফাত)।
তখন হযরত ইসমাইল (আ:) সাথে সাথে তাঁর অভিমত প্রকাশ করে বললেন

يَا أَبَتِ افْعَلْ مَا تُؤْمَرُ سَتَجِدُنِي إِنْ شَاءَ اللَّهُ مِنْ الصَّابِرِينَ

অর্থ্যাৎ : হে আমার পিতা আল্লাহ তায়ালা আপনাকে যে নির্দেশ দান করেছেন তা সহসা পালন করুন। আমাকে ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভূক্ত পাবেন। এখানে قَالَ দ্বারা ইসমাইল কে বুঝানো হয়েছে ইসহাক কে নয় কারণ তখনো ইসহাকের জন্মও হয়নি।

অত:পর তাঁরা উভয়ে যখন আল্লাহর নির্দেশের সামনে আত্মসমর্পন করলেন তথা আনুগত্যের মস্তক অবনত করে দিলেন, ইবরাহীম (আ:) যবেহ করার জন্যে প্রস্তুতি গ্রহণ করলেন আর ইসমাইল (আ:) যবেহ হওয়ার জন্যে প্রস্তুত হয়ে গেলেন।

পিতা পুত্রকে উপুড় করে শোয়ায়ে দিলেন অথবা কাত করে শোয়ালেন তখন ইসমাইল (আ:) মর্মস্পর্শী ভাষায় পিতাকে লক্ষ্য করে বললেন, হে আমার পিতা! আপনি আমাকে শক্ত করে বেঁধে নিন। আপনার ছুরি ধারাল করে নিন। ইচ্ছে করলে আমার পরিত্যক্ত (রক্তাক্ত) জামাটি আমার মায়ের নিকট পৌছে দেবেন। (ইসমাইল তখনো মায়ের কথা ভুলেন নি) হয়তো এতে আমার মা হাজেরা কিছুটা প্রশান্তি লাভ করবেন।

আমার আম্মাকে আমার সালাম পৌছে দেবেন। পুত্রের এ মর্মবিদারী ভাষণ শুনে পিতা ইবরাহীম (আ:) বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! আল্লাহর নির্দেশ পূর্ণ করার ব্যাপারে তুমি  আমার কতইনা উত্তম সাহায্যকারী। একথা বলে তিনি হযরত ইসমাইলের কপালে চুমু খেলেন এবং শক্ত করে বেঁধে ফেললেন।

হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন, হযরত ইসমাইল (আ:) কে এভাবে কাত করে শুইয়ে দিলেন যে, তাঁর কপালের এক পার্শ্ব জমিনকে স্পর্শ করেছিল, আল্লাহর ভাষায়- فلما اسلما وتله للجبين এরপরে তিনি ইসমাইলের গলদেশে ছুরি চালাতে লাগলেন। وامر السكين على حلقه কিন্তু ছুরি কোন কাজ করলনা। কেন ছুরি কাজ করল না ? কুদরতে ইলাহীর নিষেধাজ্ঞার কারণে। এ দৃশ্য অবলোকন করে ফিরিশতারা বলে উঠল- لا اله الا الله الله اكبر.

এ অবস্থায় আল্লাহর আরশেও যেন অন্তরঙ্গ বন্ধুর আনুগত্যের মস্তুক অবনত দেখে ঢেউ খেলে গেল। আল্লাহ ডাক দিলেন وَنَادَيْنَاهُ أَنْ يَا إِبْرَاهِيمُ‘  قَدْ صَدَّقْتَ الرُّؤْيَا إِنَّا كَذَلِكَ نَجْزِي الْمُحْسِنِينَ ‘  إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاءُ الْمُبِينُ অর্থ্যাৎ : হে ইবরাহীম! তুমি তোমার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করে ফেলেছ। আমি এভাবেই মুহসীনদেরকে প্রতিদান দিয়ে থাকি। মূলত: এটি ছিল তোমার জন্য আমার পক্ষ থেকে সু স্পষ্ট পরীক্ষা।

অন্য বর্ণনায় এসেছে হযরত ইবরাহীম (আ:) উক্ত আওয়ায শুনে আকাশের পানে চেয়ে দেখলেন যে, হযরত জিব্রাইল (আ:) একটি জান্নাতি দুম্বা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। কেউ কেউ বলেন এ সেই দুম্বা যা আদম (আ:) এর পুত্র হাবিল কুরবানী হিসেবে দিয়েছিল। আল্লাহ বলেন- وفديناه بذبح عظيمঅর্থ্যাৎ আর আমি তাঁকে (ইসমাইলকে) ছাড়িয়ে নিলাম এক মহান কুরবানীর বিনিময়ে। (সাফফাত)

আল্লাহর পক্ষ থেকে পাঠানো জান্নাতি দুম্বা হযরত ইবরাহীম (আ:) যবেহ করে শেষ পর্যন্ত তাঁর স্বপ্নের পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন আর আল্লাহর প্রশংসা করে বললেন ولله الحمد সকল প্রশংসা আল্লাহর জন্যেই।

আল্লাহ বলেন, ইবরাহীম (আ:) এর কোরবানীর এ স্মৃতিকে জাগরুক রেখে ইবরাহীম (আ:) এর প্রশংসাকে পরবর্তী লোকদের মধ্যে চালু রেখে দিলাম। وَتَرَكْنَا عَلَيْهِ فِي الآخِرِينَ سَلامٌ عَلَى إِبْرَاهِيمَ উপরোক্ত আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা বলতে পারি যে, মূলত ইসমাইলকে ইবরাহীম (আ:) কর্তৃক যবেহ করাটা আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল না; বরং আল্লাহর উদ্দেশ্য ছিল তার প্রিয় বন্ধুকে পরীক্ষা করা যা আল্লাহই বলে দিয়েছেন কুরআনুল কারীমের মধ্যে। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন- إِنَّ هَذَا لَهُوَ الْبَلاءُ الْمُبِينُ

ঈমানের ময়দানে আল্লাহ প্রত্যেক মুমিন থেকে পরীক্ষা গ্রহণ করেন যে, তারা আল্লাহকে বেশী ভালবাসে ? না তাদের প্রিয় বস্তুকে বেশী ভালবাসেন। যাদের ঈমান মজবুত তারা আল্লাহ কেই বেশী ভালবাসেন। আল্লাহ তায়ালা বলেন- وَالَّذِينَ آمَنُوا أَشَدُّ حُبّاً لِلَّهِ

অর্থ্যাৎ : আর যারা ঈমানদার তাদের ভালবাসা আল্লাহর জন্যেই সবচেয়ে বেশী হয়ে থাকে।
আল্লাহ তায়ালা হযরত ইবরাহীম (আ:) কে সবচেয়ে বেশী পরীক্ষা করেছেন। আর তিনি একে একে প্রত্যেকটি পরীক্ষায় ১০০% উত্তীর্ণ হয়েছেন। পরীক্ষায় সফল হওয়ার কারণে আল্লাহ হযরত ইবরাহীম (আ:) কে নেতৃত্তে¡র আসনে সমাসীন করেছেন যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
وَإِذْ ابْتَلَى إِبْرَاهِيمَ رَبُّهُ بِكَلِمَاتٍ فَأَتَمَّهُنَّ قَالَ إِنِّي جَاعِلُكَ لِلنَّاسِ إِمَاماً

অর্থ্যাৎ : আর স্মরণ কর সে সময়ের কথা যখন ইবরাহীমকে তাঁর রব কিছু كلمة দ্বারা পরীক্ষা করেছেন আর তিনি তাতে সম্পূর্ণ রূপে উত্তীর্ণ হলেন আল্লাহ ঘোষনা করলেন আমি তোমাকে মানব জাতীর নেতা বানালাম।

* কি কি বিষয় দিয়ে আল্লাহ তায়ালা ইবরাহীম (আ:) কে পরীক্ষা করলেন ?

স্ব-জাতি কর্তৃক অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ : হযরত ইবরাহীম (আ:) এর জাতী ছিল প্রতিমা পূজারী। তিনি প্রতিমা পূজা থেকে ফিরে এসে এক আল্লাহর দাসত্ব কবুল করার জন্যে স্ব জাতিকে আহবান করলেন কিন্তু জাতির লোকেরা তাঁর আহবানে সাড়া দিল না। একবার তাঁর কওমের বার্ষিক মেলায় তারা হযরত ইবরাহীম (আ:) কে দাওয়াত দিল। তিনি বললেন আমার মন খারাপ انى سقيم অত:পর তারা মেলায় চলে গেল।

ইতিমধ্যে হযরত ইবরাহীম (আ:) গোপনে তাদের উপাস্য দেবতা গুলোর নিকট গিয়ে দেখলেন তাদের সম্মুখে রয়েছে কিছু খাবার। এ খাবার দেখে হযরত ইবরাহীম (আ:) উপহাসের ছলে তাদের দেবতাদের উদ্দেশ্যে বললেন, তোমাদের কি হয়েছে ? তোমরা খাচ্ছনা কেন ? তোমরা কথা বলছনা কেন ? একথাগুলো আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনুল কারীমের মধ্যে আমাদের জন্যে রেকর্ড করে রেখেছেন আল্লাহ বলেন-

فَقَالَ إِنِّي سَقِيمٌ ‘ فَتَوَلَّوْا عَنْهُ مُدْبِرِينَ ‘ فَرَاغَ إِلَى آلِهَتِهِمْ فَقَالَ أَلا تَأْكُلُونَ ‘ مَا لَكُمْ لا تَنطِقُونَ فَرَاغَ عَلَيْهِمْ ضَرْباً بِالْيَمِينِ ‘ فَأَقْبَلُوا إِلَيْهِ يَزِفُّونَ بَلْ فَعَلَهُ كَبِيرُهُمْ هَذَا فَاسْأَلُوهُمْ إِنْ كَانُوا يَنطِقُونَ

অর্থ্যাৎ অত:পর ইবরাহীম বললেন, আমি অসুস্থ। সুতরাং তারা তাকে পশ্চাতে রেখো মেলায় চলে গেল। অত:পর তিনি তাদের উপাস্য দেবতাগুলো নিকট গমণ করলেন আর বললেন, তোমরা খাচ্ছনা কেন ? তোমাদের কি হয়েছে ? তোমরা কথা বলছনা কেন ?

এরপর হযরত ইবরাহীম (আ:) মূর্তিগুলোর মাথায় সজোরে আঘাত করে ভেঙ্গে ফেললেন, তবে বড় মূর্তিটি অক্ষত রেখে কুঠার খানা তার কাঁধের উপর রেখে দিলেন। লোকজন ছুটে এসে ইবরাহীমকে মূর্তি ভাংগার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করলে তিনি বললেন তাদের বড় জনই করেছে তাদের জিজ্ঞেস করো যদি তারা কথা বলতে পারে ? তিনি আরো বললেন, তোমরা কি এক আল্লাহর ইবাদত বাদ দিয়ে বস্তুর পুজা করবে, যারা না তোমাদের উপকার করতে পারে, আর না পারে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে ? তোমাদের জন্যে এবং তোমাদের মাবুদদের জানা আফসোস তোমাদের কি বিবেক-বুদ্ধি বলতে কিছু নেই ?

বড় মূর্তির দিকে ইশারা করে হযরত ইবরাহীম (আ:) সত্যিকার অর্থে কোন মিথ্যা বলেন নি। বরং এটি ছিল অলংকার শাস্ত্রের পরিভাষায় তাওরিয়া। আর তাওরিয়া হল এমন ভাষা ব্যবহার করা, যার দ্বারা শ্রোতার মনে যে অর্থ জাগে, বক্তার নিয়ত থাকে অন্যটি। অর্থ্যাৎ শ্রোতাকর্তৃক এক অর্থ বুঝা ও বক্তার নিয়তে অন্য অর্থ থাকা। এতে তারা আরো রাগান্বিত হয়ে গেল এবং পরস্পর পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিল যে, তারা ইবরাহীম (আ:)  কে আগুনে পুড়ে মেরে ফেলবে।

আগুণের কুন্ডলীতে হযরত ইবরাহীম (আ:) : এ প্রসংগে হযরত ইবনে আব্বাস (রা:) বলেন কাফিররা নির্দিষ্ট এলাকা জুড়ে পাথর দ্বারা একটি দেয়াল উঠিয়েছিল। যার উচ্চতা ছিল ৩০ গজ আর পরিধি ছিল ২০ গজ তথা ৬০ হাত আর ৪০ হাত, তাতে লাকড়ি ভর্তি করে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়েছিল।

১ মাস যাবত কাষ্ঠ সংগ্রহ করা হল। তাতে অগ্নি সংযোগ করে ৭দিন পর্যন্ত প্রজ্জলিত করা হল। আগুনের চারিপাশে হাজার হাজার মানুষ এ দৃশ্য দেখার জন্যে হাজির হয়েছিল। অবশেষে তারা হযরত ইবরাহীম (আ:) কে মিনজানিকে করে উপরে তুলে আবার অগ্নিকুন্ডে নিক্ষেপ করে দিল। হযরত ইবরাহীম (আ:) এ অবস্থায় একমাত্র মহান আল্লাহর নিকট সাহায্য চাইলেন, আল্লাহ সাথে সাথে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে আগুণকে বললেন-   يَا نَارُ كُونِي بَرْداً وَسَلاماً عَلَى إِبْرَاهِيمَ

অর্থ্যাৎ : হে আগুন! ইবরাহীমের জন্যে ঠান্ডা ও আরাম দায়ক হয়ে যাও। আল্লাহর অসীম কুদরতে ইবরাহীম (আ:) অগ্নিকুন্ড থেকে মুক্তি পেলেন। কাফিররা পরাজিত হল ইবরাহীম (আ:) বিজয়ী হলেন এবং নিরাপদে কওমের নিকট আবার ফিরে এলেন। কিন্তু দুষ্ট কওমের লোকেরা এ দৃশ্য দেখার পরেও ঈমান আনেনি। একমাত্র তার ভ্রাতুস্পুত্র লুত (আ:) ছাড়া আর কেউ ঈমান আনেন নি।

ইবরাহীম (আ:) তার কওম থেকে বের হয়ে সিরিয়া চলে গেলেন আর বললেন  انى ذاهب الى ربى سيهدين আমি আমার প্রতিপালকের নিকট যাচ্ছি তিনি আমাকে পথ দেখাবেন।

এসময় তার সাথে ছিলেন তাঁর স্ত্রী বিবি সারা ও ভ্রাতুস্পুত্র লুত। তিনি একাকিত্ব অনুভব করলেন। কোন সন্তান তাঁর হয়নি। কারণ তার স্ত্রী সারা ছিলেন বৃদ্ধা। মিশরের প্রেসিডেন্ট ফেরআউন। তার কন্যা হাজেরাকে সারার খেদমতের জন্যে দান করলেন। সারা হযরত ইবরাহীম (আ:) এর খেদমতের জন্যে বিবি হাজেরাকে দিয়ে দিলেন। ইবরাহীম (আ:) হাজেরাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন।

তাঁর ঘরেই জন্ম গ্রহণ করলেন প্রতিশ্রæত সন্তান হযরত ইসমাইল (আ:) যাকে কুরবানী করেছিলেন হযরত ইবরাহীম (আ:) যার পেশানীতে জন্ম গ্রহণ করেছেন আমাদের প্রিয় নবী হযরত মুহাম্মদুর রাসুলুল্লাহ (স:)। তিনি বলেছেন- انا ابن الذبيحين অর্থ্যাৎ : আমি দু যবীহ এর সন্তান। এক যবীহ হলেন হুজুরের পিতা আবদুল্লাহ; আরেক যবীহ হলেন হযরত ইসমাইল (আ:)।

* সদ্য ভুমিষ্ট সন্তানকে আল্লাহর নির্দেশে কাবায় রেখে আসা :

জন্মভ‚মি ত্যাগ করে সিরিয়ায় হিজরত করার পর হযরত ইসমাইলের জন্ম হল। সদ্য ভুমিষ্ট এ সন্তানকে এবং স্ত্রীকে কাবায় রেখে আসার জন্যে আল্লাহর নির্দেশ এসে গেল। আল্লাহর নির্দেশ পেয়ে হযরত ইবরাহীম (আ:) স্বীয় স্ত্রী ও ইসমাইলকে নিয়ে রওয়ানা হলেন। সাথে ছিলেন হযরত জিব্রাইল (আ:)। পথিমধ্যে কোন শস্যশ্যামল বনানী আসলেই হযরত ইবরাহীম খলীল বলতেন এখানে অবস্থান করানো হোক।

জিব্রীল (আ:) বলতেন, অবস্থানের নির্দেশ নেই। গন্তব্যস্থল সামনে রয়েছে। চলতে চলতে যখন শুস্ক পাহাড় ও উত্তপ্ত বালুকাময় প্রান্তর (মাক্কা) এসে গেল তখন সেখানেই তাঁদের থামিয়ে দেয়া হল। আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম (আ:) এই তৃনলতাহীন প্রান্তরেই বসবাস আরম্ভ করলেন।

* সিরিয়ায় হিজরত :

অতপর ইব্রাহীম (আ:) কে নির্দেশ দেয়া হল যে, বিবি হাজেরা ও শিশুকে এখানে রেখে সিরিয়ায় ফিরে যাও। নির্দেশ পাওয়া মাত্রই আল্লাহর বন্ধু ইবরাহীম (আ:) সাথে সাথেই সিরিয়ার দিকে রওয়ানা হলেন। হাজেরা তাঁকে চলে যেতে দেখে কয়েকবার ডেকে কাতরকন্ঠে জিজ্ঞেস করলেন আপনি আমাকে জনমানবহীন প্রান্তরে একা রেখে কোথায় চলে যাচ্ছেন। আপনি কি আল্লাহর কোন নির্দেশ পেয়েছেন ? তিনি বললেন হ্যাঁ।

আল্লাহর নির্দেশের কথা জানতে পেরে হযরত হাজেরা খুশী মনে বললেন, যান। যে প্রভু আপনাকে চলে যেতে বলেছেন, তিনি আমাদেরকে ধ্বংস হতে দেবেন না। (মাআরেফুল কুরআন-৫৯ পৃ: বাংলা)।

* তারকারাজি দ্বারা পরীক্ষা : তাফসীরে বায়যাবীতে উল্লেখ রয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীম (আ:) কে নবুয়তের পূর্বে তারকাবাজী দ্বারা পরীক্ষা করেছেন। যেমন আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন-
فَلَمَّا جَنَّ عَلَيْهِ اللَّيْلُ رَأَى كَوْكَباً قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لا أُحِبُّ الآفِلِينَ ‘ فَلَمَّا رَأَى الْقَمَرَ بَازِغاً قَالَ هَذَا رَبِّي فَلَمَّا أَفَلَ قَالَ لَئِنْ لَمْ يَهْدِنِي رَبِّي لأَكُونَنَّ مِنْ الْقَوْمِ الضَّالِّينَ ‘ فَلَمَّا رَأَى الشَّمْسَ بَازِغَةً قَالَ هَذَا رَبِّي هَذَا أَكْبَرُ فَلَمَّا أَفَلَتْ قَالَ يَا قَوْمِ إِنِّي بَرِيءٌ مِمَّا تُشْرِكُونَ

অর্থ্যাৎ অত;পর যখন রাত তাকে আচ্ছন্ন করলো তখন একটি নক্ষত্র দেখে সে বললো: এ আমার রব। কিন্তু যখন তা ডুবে গেল, সে বললো যারা ডুবে যায় আমি তাদের পছন্দ করি না। তারপর যখন চাঁদকে আলো বিকিরণ করতে দেখলো, বললো, এ আমার রব। কিন্তু তাও ডুবে গেল তখন বললো: আমার রব যদি আমাকে পথ না দেখাতেন তাহলে আমি পথ ভ্রষ্টদের অন্তরভুক্ত হয়ে যেতাম।

এরপর যখন সূর্যকে দীপ্তিমান দেখলো তখন বললো এ আমার রব এ সবচেয়ে বড়। কিন্তু তাও যখন ডুবে গেল তখন ইবরাহীম চিৎকার করে বলে উঠলেন হে আমার সম্প্রদায়ের লোকেরা তোমরা যাদেরকে আল্লাহর সাথে শরীক করো তাদের সাথে আমার কোন সম্পর্ক নেই। (সূরা মায়েদা- ৭৬-৭৮)।

* হিজরত : হযরত ইবরাহীম (আ:) হলেন পৃথিবীর প্রথম হিজরতকারী। নমরুদের অগ্নিকুন্ড থেকে আল্লাহর সাহায্যে মুক্তি পেয়ে যখন দেখলেন, কেউ তার উপর ঈমান গ্রহণ করেনি, গোটা জাতি তাঁর দুশমনে পরিণত হয়ে গিয়েছে। তখন আল্লাহর নির্দেশে তিনি শাম তথা সিরিয়ায় হিজরত করলেন। যেমন ইবরাহীম (আ:) এর যবানীতে আল্লাহ বলেন- وَقَالَ إِنِّي ذَاهِبٌ إِلَى رَبِّي سَيَهْدِينِ

* ইসমাইলকে কুরবানী : যা পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে।
এ ছাড়াও আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত ইবরাহীম (আ:) কে নি¤œ লিখিত বিষয়গুলো দিয়েও পরীক্ষা করেছেন।
১। মেহমানদারী করা।
২। খতনা করা।
৩। নখ কাটা।
৪। মোচ খাটো করা।
৫। সর্ব প্রথম সাদা চুল দেখা।
৬। মিম্বারে খোতবাহ প্রদান করা।
৭। তলোয়ার চালনা করা।
৮। মেসওয়াক করা।
৯। পানি দ্বারা ইস্তিঞ্জা করা।
১০। পায়জামা পরিধান করা।
ইবনে কাসিরের মধ্যে উল্লেখ রয়েছে- উপরোক্ত ১০টি কাজ সর্বপ্রথম ইবরাহীম (আ:) দ্বারা সম্পন্ন করা হয়েছে। অর্থ্যাৎ হযরত ইবরাহীম (আ:) ই সর্বপ্রথম এ কাজগুলো করেছেন। এছাড়াও আরো পরীক্ষার বিষয়গুলো হল।
১১। গড়গড়া করা।
১২। বগলের পশম উপড়ানো।
১৩। নাকে পানি দেয়া।
১৪। নাভীর নিচের পশম কাটা।
১৫। দাঁড়ি লম্বা করা।
১৬। কুলি করা।
১৭। মাথার চুল আঁচড়ানো বা সিঁথি কাটা।
১৮। হাত/আঙ্গুলের কর ধৌত করা ইত্যাদি।
(ইবনে কাসীর, বায়যাবী, মা’আরেফুল কোরআন)।
মূলত এ কাজগুলো নিয়মিত অভ্যাসে পরিণত করে পালন করাটা একটি পরীক্ষা ছিল। কারণ একজন ব্যক্তির পক্ষে এগুলো নিয়মিত পালন করাটা কষ্টসাধ্য বিষয়। এ পরীক্ষায় ও উত্তীর্ণ হয়েছেন আল্লাহর খলীল হযরত ইবরাহীম (আ:)।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি যে, কুরবানীর যে বিধান আজ আমরা পালন করছি তা নিছক পশু যবাইয়ের এবং গোশত ভক্ষণ করার কোন উৎসব নয়; বরং এ হল আল্লাহর নির্দেশ পালনে নিজের সকল প্রিয় বস্তুর উৎসর্গের এক বার্ষিক রিহার্সেল, যা আমাদেরকে বছর অন্তর একবার স্মরণ করিয়ে দেয় কিভাবে আমরা আল্লাহর নির্দেশের সামনে মস্তক অবনত করবো, যে কোন বিষয়ে আল্লাহর অর্ডার পালনে কোন প্রকার সংকোচ না করে তা পালন করবো। ঈমানের পরীক্ষায় ধৈর্য হারা না হয়ে অটল অবিচল থাকবো। বিনা প্রশ্নে আল্লাহর আদেশ নিষেধ মেনে চলবো এবং সর্বোচ্চ পরহেযগারী অবলম্বন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে সচেষ্ট হব।

আর ঘোষণা করবো إِنَّ صَلاتِي وَنُسُكِي وَمَحْيَاي وَمَمَاتِي لِلَّهِ رَبِّ الْعَالَمِينَ অর্থ্যাৎ : আমার নামায আমার কুরবানী আমার হায়াত, মাউত সবকিছু বিশ্বজাহানের প্রতিপালক আল্লাহর জন্যে। হে আল্লাহ তুমি আমাদেরকে তোমার প্রিয় বান্দাহদের মধ্যে দাখিল করো।

وما علينا الا البلاغ‘ والصلاة والسلام على رسول الله

মোহাম্মদ কেফায়েত উল্লাহ,
অধ্যক্ষ, দারুল ইরফান একাডেমি, চট্টগ্রাম।

——————————***——————————————